সাগরকন্যা কুয়াকাটা ভ্রমণ অভিজ্ঞতা


কুয়াকাটার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

সাগর কন্যা কুয়াকাটা শুধু বাংলাদেশ নয় সারা পৃথিবীর অনেক পর্যটক এর কাছে একটি অনন্য নাম। এটি প্রায় ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সৈকত। কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক একটি সমুদ্র সৈকত। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতটি কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলি ইউনিয়নের সর্ব দক্ষিনে অবস্থিত সমুদ্রের বুকে চর জেগে এই সৈকতটি তৈরি হয়েছে। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী ধারণা করা হয় সুলতানি বা মুঘল আমলে এই জায়গায় মানববসতি শুরু হয়েছিল। ১৮ শতকে বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে আরাকানরা প্রথম এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। বসবাস করার কারণে এই অঞ্চলে তারা প্রচুর কুয়া খনন করে। আর এজন্যই এলাকাটির নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা।

কুয়াকাটার দর্শনীয় স্থানসমূহ

কুয়াকাটা এখন একটি পর্যটন নগরী হিসেবে বাংলাদেশ সহ সমস্ত বিশ্বে খুবই পরিচিত একটি নাম। কুয়াকাটাই বসবাসকারী রাখাইনরা বহুদিন ধরে উপজাতি হিসেবে পরিচিত হলেও রাখাইনরা কুয়াকাটার আদিবাসী। ১৭৮২ সাল থেকেই রাখাইনদের উপরে বিভিন্ন অত্যাচার শুরু করা হয়। তারপর ৩২ বছরে মিয়ানমারের শরণার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক লক্ষের কাছাকাছি। 


নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক মোহময় লীলাভূমির নাম এই কুয়াকাটা। বর্তমানে এই পর্যটন নগরীকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকার কুয়াকাটা কে একটি পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা দেয়। কুয়াকাটার বিখ্যাত কুয়া যা ছিল একসময় মিষ্টি পানি একমাত্র ব্যবস্থা কিন্তু তা এখন ঐতিহ্যের অংশ।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত

কুয়াকাটার প্রধান আকর্ষণই হলো সমুদ্র সৈকত। এই সৈকতে দাঁড়ালে দক্ষিণ দিকে যতদূর চোখ চায় ততদূর শুধু নীল আকাশ। পাড়ে প্রতিনিয়ত আছড়ে পড়ে ঢেউ। এখানে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, যাতায়াতের জন্য ঘোড়া, গাড়ি ইত্যাদি।

কুয়াকাটার কুয়া

 কুয়াকাটা নামটি এসেছে মূলত কুয়া থেকে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানির আধারের পাশাপাশি এটিই একমাত্র কুয়া ছিল যেটি ছিল মিষ্টি পানির একটি অন্যতম উৎস। মূলত ধোবার গোস্ত পানি এবং বৃষ্টি পানি ছিল এই মিঠা পানির আঁধার।

নৌকা জাদুঘর

 শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার এর পাশে ভেরি বাঁধের ঢালে কুয়াকাটার এই নৌকা জাদুঘর অবস্থিত। এখানে রয়েছে একটি পাল তোলা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। এটি প্রায় দৈর্ঘ্যে ৭২ ফুট এবং প্রস্থে ২২ ফুট এবং এটির ওজন ৯০ টন। আগে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা করার জন্য এটি ব্যবহার করা হতো।

কেরানি পাড়া

কুয়াকাটার প্রাণকেন্দ্রে যে রাখাইন পল্লীতে রয়েছে সেটি মূলত কেরানি পাড়া নামে পরিচিত।

কুয়াকাটার জাতীয় উদ্যান ইকোপার্ক

কুয়াকাটা শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ৭০০ একর জায়গা জুড়ে কুয়াকাটার ইকোপার্ক অবস্থিত।

এগুলো ছাড়াও কুয়াকাটায় আর যে যে দর্শনীয় স্থানসমূহ রয়েছে সেগুলো হল গঙ্গামতির চর, আব্দুল আলী গাড়লির স্মৃতি বিজড়িত স্থান, গড়া আম কলাপাড়া রাখাইন পল্লী, আলিপুর ও মহিপুর মৎস্য বন্দর, , ইলিশ পার্ক এন্ড রিসোর্ট, শুটকি পল্লী, স্বপ্ন রাজ্য পার্ক ও রিসোর্ট, লেম্বুর বোন, ফাতরার বন, লাল কাঁকড়ার চর,পানি জাদুঘর,সোনার চর।

হোটেলের ব্যাবস্থাসমূহ

দর্শনার্থীদের জন্য বীচের নিকটেই রয়েছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্টে এর ব্যবস্থা ।হোটেলগুলোতে থাকার ভাড়াও হাতের নাগালে।

কুয়াকাটায় আমার অভিজ্ঞতা

আমরা মূলত গিয়েছিলাম আমার আব্বুর অফিসের পিকনিক এ। এ বছরই আব্বুর অফিস থেকে পিকনিক করতে যাওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছর ও পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছিল। পিকনিকের জায়গায হিসেবে ঠিক করা হয়েছিল কুয়াকাটা। 


সাতক্ষীরা থেকে সংগ্রাম পরিবহন বাস ভাড়া করে রাতে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। ভোর ছয়টার দিকে সাতক্ষীরা থেকে কুয়াকাটা গিয়ে পৌছালাম। মাঝে অনেকগুলো নদী পার হতে হয়েছে। আগে থেকেই অফিস থেকে আল বারাকা হোটেল ভাড়া করে রাখা হয়েছিল। প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে রুম ঠিক করে দেয়া হয়েছিল। 


আমাদের জন্য যে রুমটি ঠিক হয়েছিল সেটি ছিল পঞ্চম তলায়। আমাদের রুমটি ছিল অনেক আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন। রুমের পরিবেশ যেমন ভাল ছিল তেমনি বাইরের পরিবেশ ও খুবই সুন্দর ছিল। আমাদের রুমের বারান্দা থেকে সমুদ্র সৈকতটি সরাসরি দেখা যাচ্ছিল এবং সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল। দৃশ্যগুলো ছিল খুবই সুন্দর ও নান্দনিক। সকাল ৯ টার দিকে আমাকে নাস্তা করার জন্য ডাকা হল এবং আমরা সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। খাবারের দাম এবং হোটেলের ভাড়া দুইটাই ছিল খুবই সহজলভ্য এবং হাতের নাগালে।

খাওয়া শেষে আমরা রুমে ফিরে গেলাম এবং সকালে ১১ টার দিকে আমরা বাইরে বের হলাম এবং সমুদ্রের পানিতে কিছুটা সময় কাটালাম। যেহেতু তাই দ্রুত ফিরে আসলাম হোটেলে এবং রেস্ট নিলাম। দুপুর তিনটার দিকে আমরা গেলাম সৈকতে এবং দর্শনীয় স্থানগুলো কিভাবে দেখা যায় সেই সম্পর্কে মানুষদের কাছে শুনছিলাম। 


জানতে পারলাম এখানে মোটরসাইকেল এবং আরো অন্যান্য বাহন ছিল যেগুলোতে করে রিজার্ভ করে নিয়ে যে যে স্থানগুলো আমি দেখতে চাই সেগুলো দেখা যাবে। আমরা ৩০০ টাকা দিয়ে একটি মোটরসাইকেল ভাড়া করলাম। কিন্তু আমাদের পরিবারের লোক সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে আরেকটি মোটরসাইকেল ভাড়া করতে হয়েছিল। 


দুইটি মোটরসাইকেল নিয়ে আমরা রওনা দিলাম এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য। আমাদের গাইড অনেকক্ষণ বাইক চালানোর পরে আমাদেরকে প্রথমে রাখাইন পল্লীতে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম রাখাইন অনেক মানুষ তাদের সাধারণ জীবন যাপন করছে এবং দর্শনার্থী রা তাদেরকে দেখতে এসেছে। দেখলাম বাঁশের তৈরি উচু উঁচু ঘরে তারা বসবাস করে এবং খুবই সাধারণ এবং সাদামাটা জীবন যাপন করে। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পরে আমরা চললাম জায়গার উদ্দেশ্যে।

এবার আমাদের লক্ষ্য ছিল লাল কাকড়ার চর। সেই লাল কাঁকড়ার চরে যাওয়ার পথে নেমে পড়লাম ঝাউ বনের বাগানে। জীবনে প্রথমবার ঝাউবন দেখে অনেক ভালো লাগছিল। তারপর মোটরসাইকেল নিয়ে আমরা লাল কাঁকড়ার চর দিয়ে চলছিলাম। যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল তাই আমরা মোটরসাইকেল থেকে না নেমে মোটরসাইকেলে বসে কাকড়া দের আনা গোনা দেখছিলাম। 


হাজার হাজার লাল কাঁকড়া মাটি থেকে উপরে উঠে আসছিল আবার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। সেই দৃশ্যটি দেখতে খুবই সুন্দর ছিল। যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই আমরা সূর্য অস্ত যাওয়া দেখার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় উপস্থিত হলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা সূর্য অস্ত যাওয়া দেখলাম। আমাদেরকে বলা হয়েছিল আগামীকাল ঘরে ঠিক এই জায়গায় আবারও আসতে যাতে করে আমরা এই জায়গা থেকেই সূর্যোদয় দেখতে পারি।


সেখান থেকে আমরা সন্ধ্যার পর মোটরসাইকেল নিয়ে চললাম অন্যদিকে। এবার পৌঁছালাম দুবলার চরে। তারপরে শুটকি পল্লী এবং ইলিশ পার্ক এন্ড রিসোর্টেও করেছিলাম। মাঝপথে আমাদের মোটরসাইকেলের টায়ারটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাই সেটি ঠিক করার জন্য বেশ কিছু সময় লেগেছিল। তারপর আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। রাতের খাবার হোটেল থেকে খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন দুপুর একটাই আমাদের বাস ছেড়ে যাবে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে।

তাই সকাল সকাল উঠে আমরা আরেকটি মোটরসাইকেল নিয়ে কুয়াকাটা বাকি দর্শনীয় স্থানগুলো আস্তে আস্তে ভ্রমণ করা শুরু করলাম। আসলে কুয়াকাটাই এত এত দর্শনীয় স্থান রয়েছে যে আপনি যদি সবগুলো ভালোভাবে ঘুরে শেষ করতে চান তাহলে আপনার প্রায় এক সপ্তাহ সেখানে থাকতে হবে।


 কিন্তু আমাদের হাতে যেহেতু সময় ছিল না তাই আমরা যে কয়টি স্থান পেয়েছি ঘুরেছি এবং তারপরে আমাদের হোটেলে ফিরে এসেছি। এসে দেখলাম আমাদের জন্য হালকা কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেগুলো খেয়ে আমরা ব্যাগ গোছানো শুরু করলাম। দুপুর একটায় আমাদের বাস ছেড়ে দিল সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে। খুবই রোমাঞ্চকর এবং আনন্দঘন একটি ভ্রমণ ছিল এটি। আমরা সবাই খুবই মজা করেছিলাম।

Scroll to Top