দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া। ল্যাটিন শব্দ ইন্ডাস থেকে ইন্দোনেশিয়া শব্দটি এসেছে। ল্যাটিন ইন্ডাস শব্দটির অর্থ হলো দ্বীপ। আর এটি একটি দ্বীপ রাষ্ট্র বলেই এর নামের সাথে ইন্ডাস শব্দটি জড়িত। সরকারি ভাবে দেশটির নাম ইন্দোনেশীয় প্রজাতন্ত্রী।
ইন্দোনেশিয়া একটি মুসলিম প্রধান দেশ। মুসলমান সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে ইন্দোনেশিয়া পুরো বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। এদেশের শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছুতেই ইসলামিক রীতিনীতির ব্যপক প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাছাড়াও অল্প সংখ্যক অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর লেকজনও এই দেশে একসাথে মিলেমিশে বসবাস করে।ইন্দোনেশিয়ার মোট স্থলভাগের আয়তন ১৯,০৪,৫৬৯ বর্গ কিলোমিটার বা ৭,৩৫,৩৫৮ বর্গ মাইল। আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের ১৬ তম বৃহত্তম দেশ। জনসংখ্যার দিক থেকে ইন্দোনেশিয়া পুরো বিশ্বে চতুর্থ স্থান অধিকার করে আছে। ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যা ২৩,৭৬,৪১,৩২৬। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানীর নাম জাকার্তা এবং ইন্দোনেশিয়ান মুদ্রার নাম ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়াহ। ইন্দোনেশিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস, শিল্প,সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা, দর্শনীয় স্থান সহ আরও বিভিন্নগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরতে আজকের এই আয়োজন।
ইন্দোনেশিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান:
ইন্দোনেশিয়া মূলত দক্ষিন এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। এই দেশটির মূল ভূখন্ড ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের মিলনস্থলে অবস্থিত।তবে কিছু সীমানা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেও পড়েছে। ১৭৫০৪ টি দ্বীপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া গঠিত এবং এর মধ্যে ছয় হাজার টি দ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠেছে। দেশটির ভূখন্ডের এক অংশ অন্য অংশের সাথে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন বলে ভৌগলিক গঠনেও এর নানাবিধ বৈচিত্র্যতা রয়েছে।
কোন কোন দ্বীপ উর্বর মাটি দিয়ে বিস্তৃত আবার কোথাও শুধু পাহাড়ি খাদ ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ, আবার কোথাওবা দেখা যায় আগ্নেয়গিরি। ইন্দোনেশিয়ার জাভাতে ৫০ টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার প্রধান ৫ টি দ্বীপ হলো: সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও (ইন্দোনেশিয়ায় এটি কালিমান্তান নামে পরিচিত), সুলাওয়েসি এবং নিউ গিনি।
ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস
১৯৪৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়া বিশ্ব মানচিত্রে নিজেকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় দেয়ার অধিকার অর্জন করে। ইন্দোনেশিয়ার মূল ভূখন্ডে প্রথম জনমানবের পদচারণ ঘটে ১.৫ থেকে ১.৬ মিলিয়ন বছর আগে। এর পর থেকে অনেক জনপদ এই দ্বীপরাষ্ট্রে গড়ে ওঠে, আবার এরই মধ্যে কিছু কিছু জনপদ বিলুপ্তও হয়ে যায়। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতা ও বিভিন্ন মসলার উৎপাদন হতো বলে বহিরাগতদের এই ভূখন্ডে প্রতি তীব্র লালসা ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় দেশটি অনেক শাসক ও শোষকদের হাতে পরিচালিত হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় শাসনও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার ফলে এই দেশে সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী এই ভূখন্ডে রাজত্ব করেছিল।এই সময়ে পল্লব, গুপ্ত, ও পাল সাম্রাজ্যের অধিপত্য বিদ্যমান ছিল। আব্বাসীয় খিলাফত সময়কালে এই দেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এরই মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ায় মুসলিম সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটে, যা এখনও ইন্দোনেশিয়ার জনগণ নিজেদের মধ্যে লালন করে আসছে।
ইন্দোনেশিয়ায় পর্তুগীজদের প্রথম প্রথম আগমন ঘটে ১৫১১ সালে।তাদের আগমনের মূল উদ্যেশ্য ছিল ধর্মপ্রচার ও এই দেশের মূল্যবান মসলার প্রাচুর্য। এরপর ১৫৯৬ সালে এই দেশে ডাচদের আগমন ঘটে এবং তারা ৩৫০ বছর ধরে ইন্দোনেশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করে।
২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে আস্তে আস্তে এই দেশ থেকে তাদের আধিপত্য কমতে থাকে। ১৯৪৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয় এবং ১৯৪৯ সালের শেষদিকে নেদারল্যান্ডসের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৪৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়া পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয় এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিনত হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় প্রচলিত ভাষা :
ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় ভাষা হলো ইন্দোনেশীয় ভাষা। প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্ম, টেলিভিশন বা অনলাইন মাধ্যমের সকল ক্রিয়াকর্ম ইন্দোনেশীয় ভাষাতেই সম্পন্ন হয়। তবে ভাষাগত দিক থেকে ইন্দোনেশিয়ার অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। এই দেশে ৩০০ টিরও বেশি আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত আছে।
এই ভাষাগত বৈচিত্র্যের প্রধান কারণ হলো বিচ্ছিন্ন ভূখন্ড। আলাদা আলাদা দ্বীপের বাসিন্দারা তাদের দ্বীপের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। এদিক থেকে বেশির ভাগ ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক দোভাষী হয়। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে ঠিকই ইন্দোনেশীয় ভাষায় কথা বলে কিন্তু পারিবারিক ভাবে আবার নিজের দ্বীপের প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে৷ সাধারণত প্রধান প্রধান নগরী ও ভূখন্ডে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলার প্রচলন রয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ান নাগরিকদের ধর্ম:
ইন্দোনেশিয়ায় বসবাসকারী নাগরিকদের সিংহভাগই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এটি একটি মুসলমান প্রধান দেশ। এদেশের সংস্কৃতির সাথে মুসলিম ধর্মের কালচার পুরোপুরি ভাবে জড়িত। মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি এদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর নিজস্ব ধর্মাবলম্বীর লোকজন বসবাস করে। ইন্দোনেশিয়ায় বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার ৮৬.৭০% লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
মুসলিম সম্প্রদায়ের পর সংখ্যাগরিষ্ঠতার শীর্ষে আছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। দেশটির মোট জনসংখ্যার ১০.৭২% লোক খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী, ১.৭৪% হিন্দু ধর্মের অনুসারী, ০.৭৭% লোক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী রয়েছে ০.০৭%। তবে সকল সম্প্রদায়ের লোকজন মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ ভাবে এই দেশে বসবাস করে।
ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি :
বিগত ১০ বছরে ইন্দোনেশিয়া নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যপক উন্নতি ঘটিয়ে বিশ্বের সেরা ২০ টি দেশের তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়ে নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার আয়ের প্রধান উৎস পরিসেবা খাত। এই খাতে প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটে। তাছাড়াও কৃষি, শিল্প, বানিজ্য খাতেও ইন্দোনেশিয়ার আয় বেশ সমৃদ্ধশীল। ইন্দোনেশিয়া রপ্তানির থেকেও অভ্যন্তরীন উৎপাদনশীলতাকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
ফলে ২০০৭-০৯ সালের বৈশ্বিক সংকট থেকে দেশটি নিজেকে বাচিয়ে রাখতে পেরেছিল। তবুও কিছু কিছু দেশের সাথে ইন্দোনেশিয়ার বেশ ভালো বানিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে৷ ইন্দোনেশিয়ার উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক পার্টনার হল জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়া। ইন্দোনেশিয়ার উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্যগুলো হলো- তেল ও গ্যাস, খনিজ, অপরিশোধিত পাম তেল, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং রাবার পণ্য ইত্যাদি।
শিল্প খাতও দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রধান শিল্প খাতের মধ্যে রয়েছে পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস, টেক্সটাইল এবং পোশাক, খনি, পাদুকা, পাতলা কাঠ, রাবার, রাসায়নিক সার ইত্যাদি।
সেবা খাতও ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতিতে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০১৫ সালে জিডিপির ৪৩ শতাংশের অর্জন হয়েছিল শুধুমাত্র সেবা খাত থেকে।
মোট কথা ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে এই দেশের প্রতিটি খাতই সমানভাবে ভূমিকা রাখে।
ইন্দোনেশিয়ার আবহাওয়া ও জলবায়ু
ইন্দোনেশিয়ার জলবায়ু প্রায় সম্পূর্ণ গ্রীষ্মমন্ডলীয়। এখানে সাধারণত সব সময়ই স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় থাকে। সাধারনত উপকূলীয় সমভূমির গড় তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং পর্বত অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই থাকে। সুউচ্চ পর্বতমালার চূড়ার দিকে মাঝে মাঝে তুষারপাত হতে দেখা যায়।
এখানে বাতাসে জলীয়বাষ্পের উপস্থিতি অনেক বেশি বিধায় প্রচুর পরিমানে বৃষ্টিপাত হয়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুর কারনে এই দেশে ঋতুবৈচিত্রতা নেই বললেই চলে। এখানে প্রধান দুইটি ঋতুই সারাবছর বিদ্যমান থাকে৷ একটি গ্রীষ্ম ও আরেকটি বর্ষা ঋতু। ঋতুভেদে দিন ও রাতের সময়ে সামান্য কিছু তারতম্য দেখা যায়। তবে ইন্দোনেশিয়ার আবহাওয়া সবসময় সহনীয় পার্যায়ে থাকে বলে যে কেউ ঐ দেশের আবহাওয়ার সাথে নিজেকে খাপ খায়িয়ে নিতে পারবে।
ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতি :
ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতির কথা বলতে গেলে একটি নির্দিষ্ট কোনো সংস্কৃতিকে তুলে ধরা সম্ভব হয় না। ইন্দোনেশিয়ায় ৩০০ টিরও বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে এবং তাদের জীবনব্যবস্থায়ও আছে বৈচিত্র্য। আলাদা আলাদা ভূখন্ডে বসতি গড়ে উঠেছে বলে প্রতিটি জাতিসত্তার সংস্কৃতিতে ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে একই দেশের নাগরিক হওয়ার ফলে হাজার বৈচিত্র্যতা থাকলেও একটি জাতীয় মেলবন্ধন সবার মাঝেই আছে।
ইন্দোনেশিয়ান নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলার প্রবনতা অনেক বেশি। যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন, নিয়মিত প্রার্থনা করাটা তাদের একান্ত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
ইসলামিক সব ধরনের উৎসব অনুষ্ঠান খুব আনন্দের সাথে উদযাপন করা হয় এখানে। তাছাড়া যে কোনো জাতীয় দিবসে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নাচ, গান, সিনেমা, থিয়েটার ইন্দোনেশিয়ান দের কাছে জনপ্রিয় বিনোদন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারের সুবাদে এই দেশে এখন অনেকটা পশ্চিনা কালচার প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে ভারতীয় সংকৃতিও বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতিতে।
চিত্রকলা, ভাষ্কর্য ও অন্যান্য শিল্পকর্ম ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছে। তাছাড়া আলাদা আলাদা জাতিসত্তার নিজস্ব উৎসব অনুষ্ঠান তো সারাবছর ধরে লেগেই থাকে।
সব মিলিয়ে ভাষাগত বৈচিত্র্য, আলাদা আলাদা জীবনব্যবস্থা, বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় মনোভাব ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিকে অনেক বেশি সমৃদ্ধশীল ও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকদের খাদ্যাভ্যাস:
ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতির মতোই ইন্দোনেশিয়ানদের খাওয়া দাওয়ার ব্যপক বৈচিত্র্যতা লক্ষ করা যায়। অঞ্চলভেদ মানুষের খাওয়া দাওয়ায় আছে ব্যপক ভিন্নতা। তবে ইন্দোনেশিয়ান রান্নায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মালয় উপদ্বীপের পাশাপাশি ভারত, চীন এবং এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের মতো দূরবর্তী দেশের রন্ধনশৈলীর মিশ্র প্রভাব লক্ষ করা যায়।
৩০০ ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর আছে আলাদা আলাদা রন্ধনপ্রণালী এবং খাদ্যাভ্যাস। দেখা যায় একই রান্নার মধ্যেও অঞ্চলভেদে বেশ বৈচিত্র্যতা রয়েছে। পরিবেশন পদ্ধতিও একেক রকম। তবে ইন্দোনেশিয়ান রান্নার একটি কমন বিষয় হলো এই দেশের রান্নার প্রচুর পরিমানে মসলা ব্যবহার করা হয়। এবং প্রায় বেশিরভাগ ঝাল জাতীয় খাবারেই সয়া সস এর ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
সকালের খাবারে সাধারণত রুটি বা বেকড আইটেম বেশি প্রাধান্য পায়। দুপুরে ও রাতের খাবার হিসেবে ভাত, সবজি, মাছ, মাংস খাদ্যতালিকায় থাকে। ইন্দোনেশিয়ানরা পরিবারের সবাই মিলে একসাথে টেবিলে আড্ডা দিতে দিতে খাবার উপভোগ করতে ভালোবাসে।
এদেশে অনেক সুস্বাদু ফল জন্মায়, তাই খাওয়ার পরে বিভিন্ন ফল খাওয়ার প্রচলন রয়েছে এখানে। উল্লেখযোগ্য ফল গুলো হলো: আপেল, তরমুজ, আম, কলা, আনারস, পেয়ারা, রাম্বুটান, ডুকু, মাঙ্গিস, সালাক, বিখ্যাত ডুরিয়ান, পীচ, বরই, চেরি ইত্যাদি। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে এই দেশে খাওয়া দাওয়াকে বিশেষ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইন্দোনেশিয়ার দর্শনীয় স্থান হলো:

ইন্দোনেশিয়া একটি দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ার এখানে উপভোগ করার মতো অসংখ্য প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান খুঁজে পাওয়া যায়। আরও আছে সুপ্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন, পাহাড়ি উপত্যকা, অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর মসজিদ, বেশ কিছু ছবির মতো সাজানো দ্বীপ, সমুদ্র সৈকত সহ আরও অনেক আকর্ষনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
আবার চাইলে বিলাসবহুল শহরের রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে একটি রাজকীয় পরিবেশও উপভোগ করা যাবে। সেই সাথে আরও উপভোগ করতে পারবেন মায়ায় ঘেরা ছোট ছেট স্থানীয় গ্রামের সাদামাটা সৌন্দর্য।
১. বালির সৈকত
ইন্দোনেশিয়ার দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে বালির সমুদ্র সৈকত গুলো সবথেকে বেশি জনপ্রিয়। সমুদ্রের নীল পানিতে ভেসে ভেসে পুরো একটা ছুটির দিন কাটিয়ে দেয়া যায় এই বীচে এসে। এখানে বেশ কয়েকটি সমুদ্র সৈকত পাবেন এবং প্রতিটি সৈকতেরই আলাদা আলাদা বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য রয়েছে। বীচের কাছাকাছি অবস্থিত রিসোর্ট গুলো ভ্রমনের আনন্দকে আরও বেশি বাড়িয়ে দেয়।
২. বোর্নিওর ওরাংগুটান
ইন্দোনেশিয়ার বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী ওরাংগুটান। ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও নামক স্থানেই এই প্রাণীটির দেখা মিলবে এবং খুব কাছ থেকে এদের জীবনাচরণ পর্যবেক্ষণ করা যাবে। বোর্নিওতে শুধু ওরাংগুটানই নয় আরও বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় প্রাণীর দেখা মিলবে।
৩. গিলি দ্বীপপুঞ্জ
গিলি দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের প্রধান উদ্যেশ্য হলো এখানে অবস্থিত অসাধারণ সমুদ্র সৈকত ভ্রমন করা। এই সৈকত গুলোর সৌন্দর্য এতোটাই বেশি যে বালির সমুদ্র সৈকতের সাথে এর প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। এই দ্বীপটি কচ্ছপের এক বিশাল অভয়াশ্রম৷ তাছাড়া আরও দেখতে পাবেন কচ্ছপের বিশাল ঘের।
৪. কমোডো ন্যাশনাল পার্ক
কমোডো ন্যাশনাল পার্ক একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। তিনটি প্রধান দ্বীপ এবং বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে পার্কটি গঠিত। এই পার্কের মূল আকর্ষণ হলো কমোডো ড্রাগন। এটি কোনো পৌরানিক ড্রাগন নয়,তবে এটি খুব হিংস্র একটি প্রাণী। কমোডো ন্যাশনাল পার্কের আরেকটি আকর্ষণ হলো গোলাপি সমুদ্র সৈকত। এই সমুদ্র সৈকতের বালু গোলাপি রঙের এবং জলস্রোত অনেক বেশি। দর্শনার্থীদের নৌকায় করে কমোডো ন্যাশনাল পার্কে যেতে হয় এবং প্রবেশ মূল্য প্রযোজ্য।
৫. বানর বন
বানর বন ইন্দোনেশিয়ার একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। এই বনের মূল আকর্ষণ হলো লেজযুক্ত ম্যাকাক। এটি বিশেষ এক প্রজাতির বানর যা খুবই বুদ্ধিমান। বনের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে অসংখ্য বানরের দেখা মিলবে। তবে নিজেদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র খুবই সাবধানে সামলে রাখতে হবে। কেননা টুরিস্ট দের জিনিসপত্র চুরি করা এই বনের বানরদের প্রিয় একটি কাজ।
৬. মাউন্ট ব্রোমো
ইন্দোনেশিয়ায় অনেক সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে যার মধ্যে মাউন্ট ব্রোমো উল্লেখযোগ্য। এটি ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। প্রস্ফুটিত অগ্নিশিখার অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশি বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক এই আগ্নেয়গিরির চারপাশে ভীড় জমায়।
৭. তানা তোরাজা
ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন তানা তোরাজা। এটি ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ সুলাওয়েসি প্রদেশে অবস্থিত। তানা তোরাজায় দেখতে পাবেন টংকোনানের স্থাপত্য শৈলী, নৌকার আকৃতির বাড়ি ও প্রাচীন ভবনসমূহ। এছাড়াও ঘুরে বেড়াতে পারবেন এখানকার আদিবাসী গ্রামগুলি। আদিবাসীদের সাথে চমৎকার কিছু সময় কাটানোর অভিজ্ঞতাও অর্জন হয়ে যাবে।
৮. কালিমান্তান
ইন্দোনেশিয়ার কালিমান্তান নামক স্থানে একসাথে উপজাতি গ্রাম, নদী ও বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। এখানকার সবথেকে বড় আকর্ষন বোর্নি ও কায়ান নদীর ধারে দেওয়াক গ্রাম। গ্রামীন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন যাপন পদ্ধতি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। জঙ্গলে ঘেরা পুরোনো গ্রামগুলোতেও চাইলে ট্রেকিং করতে পারবেন।
৯. টোবা হ্রদ
ইন্দোনেশিয়ার আরেকটি অত্যাশ্চর্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য টোবা হ্রদ। এখানে আগ্নেয়গিরি এবং হ্রদ পাশাপাশি অবস্থিত বিধায় খুব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। হ্রদটি আয়তনে ১১৪৫ বর্গ কিলোমিটার এবং গভীরতায় ৪৫০ মিটার। লেকের পানিতে সাতার কাটা,গোসল করা এবং মাছ ধরার মতো রোমাঞ্চকর ক্রিয়াকর্ম উপভোগ করতে পারবেন। হ্রদের পাশে সাইকেলিং করতেও বেশ ভালো লাগে।
১০. বান্দা দ্বীপপুঞ্জ
বান্দা সাগরের বুকে ছোট ছোট ১০ টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত ক্লাস্টারটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা। সমুদ্র সৈকতের অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করার পাশাপাশি এখানে সামুদ্রিক মাছ ও বিভিন্ন প্রানীর দেখা মিলবে। সারাদিনের জন্য একটি বোট ভাড়া করে সবগুলো দ্বীপ ঘুরে বেড়াতে পারবেন।
সমুদ্র, নদী,খালবিল ও দ্বীপপুঞ্জে ভরপুর ইন্দোনেশিয়া। জনবল, শিল্প,সংস্কৃতি সব দিক থেকেই দেশটি নিজেকে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছে। ইন্দোনেশিয়া বর্তমানে সারা বিশ্বে স্বগর্বে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম।