আগ্রার তাজমহল ভ্রমণ গাইড। ইতিহাস, যাতায়াত, খরচ

ভারতের পশ্চিম উত্তর প্রদেশ আগরার এক রাজকীয় সমাধের নাম হল তাজমহল। মূলত আগ্রা শহরের পূর্ব দিকের যমুনা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য এই নিদর্শনটি বিশ্ব ঐতিহ্য সর্বজনীন শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে পরিচিত। শান্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক এই তাজমহল প্রেমিক যুগলদের কাছে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সুপরিচিত। তাই যুগ যুগ ধরে পর্যটকদের আকর্ষনের শীর্ষে থাকা তাজমহল দেখতে ও ইতিহাস জানতে অসংখ্য পর্যটক প্রতিবছর এসে এখানে ভিড় জমান।

তাজমহলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার দ্বিতীয় স্ত্রী আরজুমান্দবান্ন বেগম যিনি মমতাজ নামে বেশি পরিচিত কে উৎসর্গ করে এই অপূর্ব সমাধি সৌধকে নির্মাণ করেছিলেন। মমতাজ তার চতুর্দশ কন্যা জন্ম দানের সময় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মমতাজের মৃত্যুর পর সম্রাট শাহজাহান মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিলেন আর তাই স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ হিসেবে এই তাজমহল নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 


এরই ফল শ্রুতিতে ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তাজমহলে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ২২ বছর পর ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল। তাজমহলের নির্মাণ কারিগর নিয়ে অনেক ধরনের বিতর্ক থাকলেও মূলত ওস্তাদ আহমেদ লাহোরীর তত্ত্বাবধানে প্রায় দুই হাজার জন পারস্য এবং অটোমান সাম্রাজ্য ও ইউরোপের সুনিপন নকশাকার ও কারিগর পারস্য ও মুঘল স্থাপত্য অনুসারে নির্মাণ করেন। 


১৯৮৩ সালে মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন তাজমহল ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এই পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি তাজমহল দেখতে তাই প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এখানে হাজির হয়।

তাজমহল কিভাবে ঘুরে দেখবেন

আমরা তাজমহল ঘুরতে গিয়েছিলাম এবং আমাদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সেটি বর্ণনা করছি। প্রায় ৪২ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা পুরো তাজমহল কমপ্লেক্স প্রধানত পাঁচটি ভাগে বিভক্ত এগুলো হলো প্রধান ফটক, বাগান, মসজিদ, অতিথি শালা এবং চারটি মিনার সম্মিলিত সম্রাজ্ঞী মমতাজের সমাধি সৌধ। 

তাজমহল


তাজমহলের যে মূল চত্বরটি রয়েছে সেটি দুর্গের মত তিন দিক থেকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা রয়েছে। এই প্রাচীরের বাইরে সম্রাট শাহজাহানের অন্যান্য স্ত্রী ও মমতাজের প্রিয় পরিচারি কাদের সমাধি অবস্থিত। প্রাচীরের ভিতরে দেয়াল গুলো নকশা খচিত। 
সবগুলো প্রাচীর দিয়ে গম্বুজ আকৃতির একটি স্থাপত্য গড়ে তোলা হয়েছে এবং এটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মুঘল স্থাপত্য ও নকশা খচিত তাজমহলের প্রধান প্রবেশদ্বার মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মূল চত্বরে দুইটি পৃথক স্থাপনায় লাল রঙের মসজিদ ও মোঘল অতিথি শালা জওয়াব রয়েছে।

এগুলো দেখতে খুবই মনোমুগ্ধকর। তাজমহলের সামনের চত্বরে একটি চারবাগ রয়েছে। এটি প্রধানত সবার কাছে স্বর্গের বাগান হিসেবে পরিচিত। খুবই সুন্দর জায়গা এটি। তাজমহল ভ্রমন করতে গেলে অবশ্যই এই জায়গাটি দেখে যাবেন। 


উচু উঁচু প্রাচীর দিয়ে ১৬ টি আলাদা ফুলের বাগান ও গাছ গাছালিতে ঘেরা চলাচলের রাস্তা এবং সুন্দর কিছু ঝর্ণা ব্যবস্থা এখানে করা হয়েছে। সমাধের অংশ ও প্রধান গেটের মাঝামাঝি অংশে একটি মার্বেল পাথরের চৌবাচ্চা রয়েছে যার পানিতে পুরো তাজমহলের প্রতিফলিত রূপ দেখা যায়। সমাধির ভেতরের অন্দরমহল অষ্ট ভজাকৃতির খোদাই করা অর্ধবৃত্তাকার মার্বেল পাথর দিয়ে সাজানো। 


এখানেই মূলত সম্রাট শাহজাহান ও তার স্ত্রী মমতাজের সমাধিস্থল। যদিও এগুলো শুধু ডামি সমাধি যা সূক্ষ্ম তারের কারুকার্য মন্ডিত মার্বেলের এক ধরনের পর্দা দিয়ে আবৃত। এই সমাধিস্থলের 80 ফুট নিচে ভাস্কর্য শিল্পে অলংকৃত শিলালিপিতে সমন্বিত রয়েছে তাদের প্রকৃত সমাধি যেটি কখনো উন্মুক্ত করা হয় না। যখন পূর্ণিমার সময় হয় তখন সমাজের ওপর চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয় এবং তখন চারপাশে এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হতে দেখা যায়।

তাজমহল কমপ্লেক্স এর ভিতরে পেট্রা দুরা কৌশল ব্যবহার করে মূল্যবান পাথরের উপর জ্যামিতিক ও ফুলেল নকশায় পবিত্র কুরআনের আয়াত সুন্দরভাবে খোদাই করা রয়েছে। এই কাজগুলো দেখলে যে কারোরই ভালো লাগবে। শোভা মণ্ডিত এই কারুকার্য গুলো সকল পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। আমরা বেশ কিছুটা সময় শুধু এই নকশাগুলোই দেখছিলাম।

প্রচলিত আছে জীবনের শেষ সময়ে সম্রাট শাহজাহান যমুনা নদীর তীরে তাজমহলের বিপরীতে আরেকটি তাজমহল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন যা বর্তমানে কাল্ল্য তাজমহল নামে পরিচিত। এখান থেকে সূর্যের ও চাঁদের আলোয় তাজমহলের বিভিন্ন পরিবর্তিত অপরূপ সুন্দর রূপ দেখা যায়। 
দিনের বেলা এবং রাতের বেলা দুই সময় খুবই সুন্দর দেখা যায়। কালো মার্বেল দিয়ে তৈরি করা এই দুর্গ ব্রিজের মাধ্যমে তাজমহলের সাথে সংযুক্ত।


আর তাজমহল থেকে এক মাইল দূরে যমুনা নদীর ডান দিকে আগ্রাফোট অবস্থিত যা মুঘল আমলে সেনাদের দুর্গা থাকলেও পরবর্তী সময় শাহজাহানের নেতৃত্বে রাজ পরিবারের বাসস্থানের সাথে সাথে রাজকীয় নানা কর্মকান্ডের মূল স্থান হিসেবে পরিচিতি পায়।

তাজমহল

আমরা তাজমহলে কিভাবে গিয়েছিলাম

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে দিল্লি যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে।

ঢাকা থেকে বিমানে দিল্লি 

বাংলাদেশ থেকে বিমানের সরাসরি দিল্লি যাবার ফ্লাইট আছে।  ইয়ার লাইনস গুলোর ফ্লাইট ঢাকা থেকে দিল্লি সরাসরি অথবা ঢাকা টু কলকাতা টু দিল্লি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। নন স্টপ ফ্লাইট গেলে ঢাকা থেকে যেতে সময় লাগবে প্রায় দুই ঘন্টা তিরিশ মিনিট। আর কলকাতায় স্টপেজ হয়ে গেলে এক এক ফ্লাইটে একেক রকম সময়। সাধারণত সর্বনিম্ন ৫ ঘন্টা থেকে ১৪ ঘন্টা লাগে।

বাংলাদেশ থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লি

বাংলাদেশ থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লি অনেকভাবেই যাওয়া সম্ভব। যেমন ঢাকা থেকে ট্রেনে মৈত্রী এক্সপ্রেস এ কলকাতা গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে দিল্লি যেতে পারবেন অথবা কলকাতা থেকে বিমানে করে দিল্লি যেতে পারবেন। আবার বাংলাদেশ থেকে বাসে সরাসরি কলকাতা যেতে পারবেন অথবা বেনাপোল সীমান্তে গিয়ে সেখানে ইমিগ্রেশন শেষ করে কলকাতা যাওয়া যাবে। আর কলকাতা থেকে ট্রেনে অথবা বিমানে দিল্লি যেতে পারবেন।

কলকাতা থেকে ট্রেনে দিল্লি

 কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার অনেক ট্রেন রয়েছে। কোন সময় পৌছাই এমন ভালো ফ্রেন্ড সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে হাওড়া নিউ দিল্লি দুরন্ত এক্সপ্রেস, হাওড়া কালকা মেইল ইত্যাদি। ভালো ট্রেনের জন্য টিকিট অগ্রিম কেটে রাখা ভালো।

তাজমহল ভ্রমন খরচ

ট্রেনে দিল্লি যেতে ১৫০০ থেকে ৩০০০ রুপি খরচ হবে আর বিমানের ক্ষেত্রে খরচ হবে ২৮০০ থেকে ৪০০০ রুপি। যানবাহনের উপর নির্ভর করে দিল্লি থেকে আগ্রা যেতে ৫০০ থেকে ১২০০ রুপির মত খরচ হবে। তাজমহলে জনপ্রতি প্রবেশ টিকেট মূল্য ৫১০ রুপি।

আমরা কলকাতা থেকে ট্রেনে করে গিয়েছিলাম দিল্লি পর্যন্ত এজন্য আমাদের একটু কম খরচ হয়েছিল। আমার কিছু বন্ধু বিমানে যেতে বলছিল কিন্তু আমি বললাম ট্রেনে যাই মজা হবে এবং বাকি টাকা আমরা ওখানে গিয়ে খরচ করতে পারব।

আগ্রায় কোথায় থাকবেন

আগ্রাতে কম খরচের মধ্যে ছাই প্যালেস, হোটেল সাফারি, ম্যাক্স গেস্ট হাউস, দ আগ্রা গ্রান্ড, টুরিস্ট রেস্ট হাউস, রে অফ মায়া, থমাস হোমস্টে, সেভেন হিলস টাওয়ার এর মত হোটেল ও রেস্ট হাউসে ৬০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে দুইজনে থাকার রুম পাওয়া যায়। আমরা যেহেতু ৬ জন ছিলাম তাই আমরা তিনটি রুম নিয়েছিলাম। রুমগুলোর কোয়ালিটিও বেশ ভালো। উন্নত মানের সুযোগ সুবিধা পাবেন এ সকল রুমগুলোতে।

তাজমহল ভ্রমণের পরামর্শ

১. খুব গরমে আগরাতে না যাওয়াই ভালো নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস আগ্রাতে যাওয়ার জন্য ভালো সময়।

২. বসন্ত ও পূর্ণিমার রাতে তাজমহলের অলৌকিক সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হলে তা মিস করলে পরবর্তীতে আফসোস করবেন। এজন্য বসন্ত ও পূর্ণিমার রাতে আগ্রার সৌন্দর্য লুফে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

৩. তাজমহলের এন্ট্রি টিকেট দেখিয়ে আগ্রাফরটে ঢুকলে ৩০ রুপি খরচ হবে তা না হলে আলাদা করে ৫০০ রুপি খরচ করে টিকেট কাটতে হবে তাই তাজমহলের এন্ট্রি টিকিট দেখিয়ে আগ্রা ফোর্টে ঢোকার পরামর্শ থাকলো।

৪. একদিন পুরো সময় নিয়ে আগ্রাতে রাতে থেকে তাজমহল ঘুরে আসবেন তাহলে ভালোভাবে সব দেখতে পারবেন।

৫. তাজমহলে প্রবেশের সময় এক বোতল পানি দেয়া হয় এই পানি ছাড়া তাজমহলের ভিতরে অন্য কোন খাবার নিয়ে প্রবেশ করা যায় না তাই আগে থেকে একটু খাওয়া দাওয়া করে আসবেন।

৬. তাজমহলে প্রবেশের সময় পাসপোর্ট সাথে রাখুন না হলে সমস্যা হতে পারে।

৭. শুক্রবার তাজমহলে জুম্মার নামাজ হয় তাই সেদিন এখানে প্রবেশ নিষেধ। তাই আমি বলব শুক্রবার বাদে অন্য কোনদিন যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।

সর্বোপরি বলতে চাই আমরা শিত মৌসুমে গিয়েছিলাম এবং খুব ভালোভাবে আগ্রা ঘুরতে পেরেছিলাম আপনারও ভালোভাবে বুঝে শুনে সময় করে আগ্রায় যাবেন এবং নিজেদের সময় গুলো উপভোগ করবেন।

tour package
Scroll to Top